Monthly Archives: জুন 2018

ঘুরে এলাম হারিয়ে যাওয়া শহর “পানাম সিটি”

ঘুরে এলাম হারিয়ে যাওয়া শহর “পানাম সিটি”

২২ শে জুন, ২০১৮, শুক্রবার। বাসায় আমি একা। বৌ বাচ্চারা সব ঈদের ছুটিতে ঢাকার বাইরে। অবশ্য আজকে তাদের বাসায় ফেরার কথা। আমি দোআহারী হওয়ায় নিশ্চিন্তে ফজরের সলাত আদায় করে সেই রকম একটা ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালাম। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না। হঠাৎ মোবাইলের মিষ্টি ছান্দিক ডাকে সাড়া দেয়ার জন্য বিছানা ছাড়তেই হলো। ভাবলাম বৌ ফোন দিয়েছে রওনা হওয়ার সংবাদ দিয়ে। কিন্তু না, দেখি দ্বীনি ভাই সাইদুজ্জামান খান ফোন দিয়েছেন। কল রিসিভ করে সালাম দিতেই বললেন, কি খবর বাসায় নাকি? চলেন কোন জায়গায় ঘুরে আসি। আমি বললাম, কোথায় যাবেন? বললো, চলেন ডেমরা, সোনারগাঁ’র দিকে। আমি একটু সময় চেয়ে নিলাম। কারণ বৌ বাচ্চারা এসে পড়লে খাবে কি? ওদের জন্য তাই স্পেশাল ডিম মাসালা আর ভাত রান্না করে গোসল সেরে রেডি হয়ে গেলাম। সোয়া এগারটার সময় বাসা ছেড়ে বেড়িয়ে পড়লাম মুক্ত হাওয়ার স্বাদ নিতে।

সাঈদ ভাই আসতে আসতে প্রায় পৌনে বারোটায় দক্ষিণ বনশ্রী সিএনজি স্ট্যান্ড থেকে শেয়ারে অটোরিক্সায় উঠে পরলাম। গন্তব্য আপাতত ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার। ঈদের ছুটির কারণে রাস্তা ফাঁকা থাকায় আধা ঘন্টার মধ্যেই পৌছে গেলাম। সেখান থেকে ডাইরেক্ট সোনারগাঁও যাবার পাবলিক সার্ভিস গাড়ী না পাওয়ায় আসমানী পরিবহনে গেলাম মদনপুর। সেখান থেকে নাকি লেগুনা যায় মোগরাপাড়া বাসস্ট্যান্ড। আমরা মদনপুর নেমে মোগরাপাড়া যাওয়ার লেগুনায় চড়তে যাবো কিন্তু দেখি যাত্রী বলতে আমরাই দু’জন। ওরা দুজন নিয়ে কখনোই লেগুনা ছাড়বে না। সুতরাং এই ভ্যাপসা গরমে আধা ঘন্টাও বসে থাকা লাগতে পারে। কি করা যায় এমন পরিস্থিতিতে সেটা ভাবতে যেই না শুরু করেছি হঠাৎ দেখি একটি খালি বাস থেকে হেলপার যাদুঘর! যাদুঘর! সোনারগাঁও বলে ডাকতেছে। আমরা দ্রুত বাসে উঠে বসলাম। কন্ডাক্টরকে ভাড়া জিজ্ঞেস করতেই বললেন হুজুর ঈদের আগে যা দিতেন তাই দেন। আমি বললাম, এবারই প্রথম যাচ্ছি। শুনে বললো, তাহলে আপনি দশ টাকা দেন। আমাদেরকে বাস সোনারগাঁও যাদুঘরের সামনে নামিয়ে দিলো। আমরা নেমেই এক রিক্সাওয়ালা ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, এখানে দেখার মতো মোটামুটি ভালো প্রাকৃতিক পরিবেশ আছে কোনদিকে? সে বললো, চলেন পানাম নগর নিয়ে যাই, ওখানে পুরাতন বাড়িগুলো দেখবেন, পরিবেশও সুন্দর। ভাড়া না মিটিয়েই উঠে পরলাম। রিক্সা ছুটে চললো পানাম নগরের দিকে। গাছের ছায়া আর সবুজ পাতার ফাকঁ গলে আসা মিষ্টি মধুর হাওয়ায় দেহ জুড়িয়ে যাচ্ছিলো। মিনিট দশেকের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম প্রাচীন বাংলার ভোগবাদীদের নিদর্শন পানাম নগরের মূল ফটকে। রিক্সা ভাড়া রাখলো দশ টাকা।

মূল ফটকের পাশেই দর্শনার্থীদের জন্য দর্শন ফি বাবদ ১৫টাকা করে অগ্রিম পরিশোধ করে টিকিট সংগ্রহ করার সুবন্দোবস্ত করা হয়েছে। আমরাও যথারীতি টিকিট কেটে ফটক পেরিয়ে ইতিহাসের পাতায় “হারিয়ে যাওয়া শহর” হিসাবে পরিচিত পানাম নগর বা পানাম সিটির মূল রাস্তায় প্রবেশ করলাম। জুমু’আর সালাতের সময় হয়ে যাওয়ায় আমরা মাসজিদ তালাশ করতে লাগলাম। মূল রাস্তা ধরে কিছুদূর যেতেই ডান পাশে পুকুর পাড়ে “বায়তুস সালাহ” নামে একটি মাসজিদ খূঁজে পেলাম। সেখানে সালাত আদায় শেষে শুরু হলো ঘুরাঘুরি। গ্রামের লোকজন রাস্তার আশে পাশে মৌসুমী ফলের পশরা সাজিয়ে বসেছিল। ডেওয়া, কালো জাম, দেশী কলা, আম, জামরুল, গাব, কামরাঙ্গা হরেক রকমের ফল। রসালো ফলের লোভে আমার কন্ঠনালী শুকিয়ে এলেও কিছু করার ছিলো না। কারণ পকেটে টাকা থাকলেও শাওয়ালের নফল সিয়ামের কারণে জিহ্বাকে সংযত রাখতে হলো। অবশ্য সাঈদ ভাই বাচ্চাদের মতো যথাসাধ্য খেয়েই যাচ্ছিলেন জাম ভর্তা, কলা, জামরুল, আলুচপ, পিয়াজু…। আমরা অবশ্য দু’জনেই টাটকা ডেওয়া আর জামরুল কিনে নিয়েছিলাম ব্যাগ ভর্তি করে।

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ২৭ কিলোমিটার দূরত্বে মোগরাপাড়া পয়েন্টের পাশে প্রায় ২.৫ কিলোমিটার উত্তরে সোনারগাঁও পৌরসভার একটি প্রাচীনতম শহর এই পানাম সিটি। ১৫ শতকে ঈসা খাঁ বাংলার প্রথম রাজধানী স্থাপন করেছিলেন সোনাগাঁওয়ে। ঈসা খাঁর যাতায়াত ছিল এই নগরীতে। সেই সময়টাতেই অর্থাৎ সুলতানি আমলে বাংলার শিল্প ও সংস্কৃতি বিকাশ লাভ করে। পূর্বে মেঘনা আর পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা নদীপথে বিলেত থেকে আসতো বিলাতি থানকাপড়, দেশ থেকে যেতো মসলিন। এই সোনারগাঁওয়েরই একটি এলাকার নাম পানাম। স্থানটি পুরনো রাজ-রাজরাদের আমলে প্রসিদ্ধ এলাকা ছিল। পরে ইংরেজ শাসনামলে এখানে অভিজাত হিন্দুদের আবাস গড়ে ওঠে। ইউরোপীয় স্থাপত্যরীতিতে তৈরি এখন পর্যন্ত টিকে থাকা ইমারতগুলো মূলত সেসময়েই তৈরি। অসাধারণ কারুকার্যময় এবং সুবিন্যস্ত একটি প্রাচীন নগরী হিসেবে পানাম এখনও সবার মন কাড়ে।

পৃথিবীর ১০০টি ধ্বংসপ্রায় ঐতিহাসিক শহরের একটি পানাম নগর। World Monuments Fund ২০০৬ সালে Panam City কে বিশ্বের ধ্বংসপ্রায় ১০০টি ঐতিহাসিক স্থাপনার তালিকায় প্রকাশ করে। বড় নগর, খাস নগর, পানাম নগর -প্রাচীন সোনারগাঁর এই তিন নগরের মধ্যে পানাম ছিলো সবচেয়ে আকর্ষণীয়। আজ থেকে প্রায় ৪৫০ বছর আগে বার ভূইয়ার দলপতি ঈশা খাঁ ১৫ শতকে বাংলার প্রথম রাজধানী স্থাপন করেছিলেন সোনারগাঁওতে। সোনারগাঁর ২০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে এই নগরী গড়ে ওঠে।

পানাম নগরে ঢুকেই আপনি হারিয়ে যাবেন কোন এক অতীতে। এই শান্ত সুনিবিড় নগরে কালের সাক্ষী হয়ে রাস্তার দুধারে দাড়িয়ে আছে অর্ধশত ভবন। সংস্কারের অভাবে ভবনগুলো জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। প্রায় প্রতিটি বাড়িতে নোটিশ ঝুলছে “ঝুঁকিপূর্ণ ভবন”। ভবনের জানালাগুলো ইটের গাঁথুনি দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। পুরনো দালানগুলোর কোনটা দোতলা আবার কোনটা এক তলা। বাড়িগুলোর স্থাপত্য নিদর্শন দেখলেই বোঝা যায় এখানে ধনী বণিক শ্রেণীর ভোগ-বিলাসী লোকেরা বসবাস করতেন। বাড়ীগুলোতে মোঘল ও গ্রীক স্থাপত্যশৈলীর মিশ্রণ দেখা যায়। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, প্রতিটি বাড়ির কারুকাজ স্বতন্ত্র। কারুকাজ, রঙের ব্যবহার এবং নির্মাণকৌশলের দিক থেকে নতুন নতুন উদ্ভাবনী কৌশলের প্রমাণ পাওয়া যায় বাড়িগুলোতে। প্রায় প্রতিটি বাড়ি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে ঢালাই লোহার তৈরি ব্রাকেট। জানালায় ব্যবহার করা হয়েছে লোহার গ্রিল এবং ঘরে বাতাস চলাচলের জন্য ভেন্টিলেটার ব্যবহার করা হয়েছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল বাড়িগুলোতে কাস্ট আয়রনের নিখুঁত কাজ করা হয়েছে এবং ইউরোপের পুরোনো বাড়িগুলোতে ব্যবহৃত কাস্ট আয়রনের কাজের সাথে এই কাজের অনেক মিল পরিলক্ষিত হয়। এছাড়াও মেঝেতে লাল, সাদা, কালো মোজাইকের কারুকাজ লক্ষ্যনীয়। নগরীর ভিতরে আবাসিক ভবন ছাড়াও আছে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, মঠ, গোসলখানা, নাচঘর, পান্থশালা, চিত্রশালা, খাজাঞ্চিখানা, দরবার কক্ষ, গুপ্ত পথ, বিচারালয়, পুরনো জাদুঘর।

এছাড়া আছে ৪০০ বছরের পুরনো টাকশাল বাড়ি। পানাম নগরে টিকে থাকা বাড়িগুলোর মধ্যে ৫২টি বাড়ি উল্লেখযোগ্য। একটি দশ ফুট প্রশস্ত রাস্তা পানাম নগরীর ভেতর দিয়ে চলে গেছে। এটিই মূল সড়ক। আর এর উত্তর পাশে ৩১টি আর দক্ষিণ পাশে ২১টি বাড়ি রয়েছে। প্রায় প্রতিটি বাড়ি দুটি অংশে বিভক্ত। একটি বহির্বাটী এবং অন্যটি অন্দর-বাটি এবং বাড়ির সামনে উন্মুক্ত উঠান আছে। প্রতিটি বাড়ি একটি থেকে অপরটি নির্দিষ্ট দূরত্বে অবস্থিত। এই রাস্তার দুপাশেই মূলত পানামের বাড়িগুলো তৈরি করা হয়েছে।

ভোগ বিলাসের নিখুঁত পরিকল্পনার ফসল ছিলো এই পানাম নগর। পানাম নগরের পরিকল্পনায় ছিল আধুনিকতার ছোঁয়া। নগরে পানি সরবাহের জন্য দু’পাশে কাটা হয় (যা এখনও আছে) ২টি খাল এবং ভেতরে খনন করা হয় ৫টি পুকুর। আর সুপেয় পানির জন্য পানাম নগরের প্রতিটি বাড়িতেই ছিল কূপ বা ইঁদারা। নগরীতে যেন জলাবদ্ধতা না হয় সেই জন্য পানি নিষ্কাশনের জন্যও ড্রেনেজ ব্যবস্থা নেয়া চালু ছিল।

পানাম নগরের সুরক্ষিত স্থাপনা ছাড়াও আপনি ঘুরে দেখতে পারেন সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহীর শাসনামলে নির্মিত একটি মসজিদ। মসজিদটির নাম গোয়ালদী হোসেন শাহী মসজিদ। সোনারগাঁ লোকশিল্প জাদুঘর থেকে পশ্চিম দিকে রয়েছে এই মসজিদ। মগরাপাড়া থেকে দক্ষিণ দিকে আরও কিছু ইমারত আছে যেমন বারো আউলিয়ার মাজার, হযরত শাহ ইব্রাহিম দানিশ মন্দা ও তার বংশধরদের মাজার, দমদম দূর্গ ইত্যাদি। পানাম নগরে রয়েছে অসংখ্য ঐতিহাসিক নিদর্শন। ঈসা খাঁর ছেলে মুসা খাঁর প্রমোদ ভবন যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে ফতেহ শাহের মাজার, সোনাকান্দা দুর্গ, পঞ্চপীরের মাজার, চিলেকোঠা সহ অসংখ্য পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন।

দুনিয়ালোভী আখিরাতবিমুখ ইনসাফহীন ভোগবিলাসী মানুষজন যে মাজলুমের দীর্ঘশ্বাসে কালের অতল গহ্বরে হারিয়ে যান আর রেখে যান বিলাসবহুল কুকির্তীগাথা তাদের বসবাসকৃত স্থাপনার প্রতিটি ইট, কাঠ, লৌহের কণায় কণায় তা আরেকবার অবলোকন করার সৌভাগ্য করে দেয়ার জন্য মহান আল্লাহর দরবারে আন্তরিক শুকরিয়া ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।

যেভাবে যেতে পারেন-
গুলিস্তান থেকে স্বদেশ, বোরাক ও সোনারগাঁ নামক বাসে উঠে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সোনারগাঁ মোগরাপাড়া চৌরাস্তায় নামতে হবে। মোগরাপাড়া থেকে লোকশিল্প জাদুঘরের দূরত্ব প্রায় ২ কি.মি.। চাইলে রিক্সা অথবা সিএনজি তে করে যেতে পারেন। যদি তাড়াতাড়ি যেতে চান তাহলে সিএনজি নিয়ে নিন। তা নাহলে রিক্সাতে যাওয়াই ভাল। গ্রামের আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে রিক্সায় যেতে খারাপ লাগবেনা। তাছাড়াও নিজস্ব যানবাহন নিয়েও যেতে পারেন। জাদুঘরের সাথেই আছে পার্কিং স্থান। এখান থেকে পানাম নগর খুব কাছেই। চাইলে হেঁটেই যেতে পারবেন।