এ্যাডভেঞ্চার এট সীতাকুন্ড চন্দ্রনাথ পাহাড়

এ্যাডভেঞ্চার এট সীতাকুন্ড চন্দ্রনাথ পাহাড়

আমাদের এই এডভেঞ্চারটা ছিল নাটকীয়তায় ভরপুর।
সরকারী ছুটির কারণে কাজের প্রচন্ড প্রেসারের মাঝেও শুক্র-শনি (১৫-১৬ ডিসেম্বর) দুইদিন ছুটি পেয়ে গিয়েছিলাম। কনফার্ম ছুটির কারণে তাই ট্যুর ফাইনাল হয়ে গিয়েছিলো তিনদিন আগেই। কিন্তু ট্যুরের আগের দিন একের পর এক একজন করে ট্যুর ক্যানসেল করতে লাগলো বিভিন্ন অজুহাতে। যেদিন যাত্রা শুরু হবে সেদিনও কনফার্ম একজন সম্পূর্ণ আজাইরা অজুহাতে Uটার্ন নিলো। বাকি রইলাম শাওন আর আমি দুইজন। শুক্রবার আমার দাওয়াতী প্রোগ্রাম থাকায় বিকেলেই ব্যাগ এন্ড ব্যাগেজ বাসা থেকে বিদায় নিয়ে এসেছি। উদ্দেশ্য প্রোগ্রাম শেষ করে সরাসরি কমলাপুর চলে যাবো। কিন্তু প্রোগ্রাম চলাকালীন রাত আটটায় শাওন ফোন দিলো শুধু দু’জন গিয়ে মজা পাবো না, চলেন বাসায় ফিরে যাই। আমি বললাম, তুমি আসছো নারায়ণগঞ্জ থেকে আর আমিও বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এসেছি সুতরাং বাসায় ফেরা সম্ভব নয়! বৌ বাচ্চা পচানি দিবে! তুমিও না গেলে আমি একাই যাবো। শেষে শাওন বললো আপনি একটু আনিস ভাইকে (অফিস কলিগ) ফোন দেন। আনিসকে ফোন দিতেই বললো- ভাই আমি সাড়ে দশটার মধ্যে কমলাপুর উপস্থিত হচ্ছি। যাক কিছুটা স্বস্তি পেলাম। রাত সাড়ে ন’টায় কমলাপুর চলে এলাম। দেখি শাওন চলে এসে টিকিট কিনে রেখেছে তিনজনের। চিটাগাং মেইল ট্রেন। টিকিট ১১০টাকা জনপ্রতি। ট্রেন সাড়ে দশটায়। আনিস ঠিক সাড়ে দশটায় ধুম্র উদগীরন করতে করতে উপস্থিত হলো। ট্রেন লেট এ আসলো। প্রায় এগারোটায় দুই নম্বর প্লাটফর্মে ঢোকার হুইসেল শোনা গেলো। মেইল ট্রেন ভ্রমণে অভ্যস্ত আনিস হুইসেল শুনেই বললো- ভাই আমি আর শাওন শেষ প্রান্তে যাচ্ছি, না হয় সীট খালি পাওয়া যাবে না। আমি আর একজন veterinarian জাহিদ ভাই (উনিও ঢাকা থেকে চিটাগাং ভেটেরিনারি মেডিকেলে যাচ্ছিলেন, প্লাটফর্মে দেখা হয়ে গেছে) অপেক্ষা করতে লাগলাম। মিনিট দশেক পর শাওন ফোন দিলো ২ নম্বর বগিতে সীট পাওয়া গেছে। ট্রেন মূল প্লাটফর্মে ঢোকার পর দেখলাম লোকজন দৌড়ে জানালা দিয়ে ভিতরে ঢুকছে। ভয় পেয়ে গেলাম আমরা উঠবো কিভাবে! যাক শেষ পর্যন্ত ভীড় ঠেলে ২নম্বর বগিতে উঠে বসলাম আগেই দখল করে রাখা সীটে। কিন্তু একি! সীটের যে অবস্থা তাতে শীতের রাতে আট ঘন্টার ভ্রমণ শেষে ঘুরাঘুরি করার এনার্জি থাকবে তো! ট্রাভেলার মোট তিনজন মিলেই যাত্রা শুরু হলো সাড়ে এগারোটায় ‘শীতের দ্বিতীয় সফর’ সীতাকুন্ড ভ্রমণ। গল্পের বাকি অংশটুকু আমাদের ৩ ট্রাভেলার্স কে নিয়েই!

ট্রেন এগিয়ে চলছে মোটামুটি ৫০ কিমি. গতিতে। ট্রেন ভৈরব পৌছে কিছুক্ষণ বিরতি দিলো। এই সুযোগে সিদ্ধ ডিম আর ব্রেড খেয়ে নিলাম। ১৫ মিনিট যাত্রা বিরতির পর ট্রেন আবর ছুটে চললো। কিন্তু প্রচন্ড কুয়াশর কারণে এবার গতি মন্থর। ট্রেন ভোর রাতে আখাউড়া জংশনে পৌঁছলে আবার বিরতি দিলো যাত্রায়। এখানে কয়লার আগুনের তাপে বানানো মজাদার চা খেলাম সাথে মসলাদার চানাচুর! ট্রেন আবার ছুটে চললো। অবশেষে সকাল সাতটায় সীতাকুণ্ড পৌঁছলাম।

পৌঁছে রেল স্টেশনের পাশে ছাপড়া মসজিদে ফজরের সলাত আদার করে নিলাম।

এরপর হেঁটে সীতাকুণ্ড বাজার এলাম। সেখানে নাস্তা সেড়ে সিএনজি অটোরিক্সায় সীতাকুন্ড পাহাড়ের পাদদেশে এসে নামলাম। রেল স্টেশন থেকে ৪কি.মি. পূর্বে চন্দ্রনাথ পাহাড় অবস্থিত।
শুরু হলো পায়ে হাটা পাহাড়ি পথে যাত্রা। পায়ে হেঁ‌টে ভ্রমনের মজাই আলাদা। চন্দ্রনাথ পাহাড় শ্রেণীভূক্ত ছোট পাহাড় গুলো ব্যাসকুণ্ড থেকে শুরু হয়েছে। সীতাকুন্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চূড়ায় যাবার পথে হিন্দুদের বেশকিছু ধর্মীয় স্থাপনা আপনার চোখে পরবে।

এই এলাকা বিভিন্ন ধরনের গাছ, বুনোফুল এবং গুল্মলতায় পরিপূর্ণ। বোটানি এবং জীববিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের শিক্ষা প্রকল্পের কাজের জন্য প্রায়ই এখানে আসেন। এখানে আপনি পেয়ারা, সুঁপাড়ি, আম সহ বিভিন্ন ফলের বাগান দেখতে পাবেন। এখানে কিছু নৃতাত্বিক জনগোষ্ঠীর মানুষও বসবাস করে, যারা ত্রিপুরা নামে পরিচিত এবং এখানে তাদের কিছু গ্রামও আছে। আপনি যদি পাহাড়ের গভীরে যান তবে পাহাড়ের গায়ে জুমচাষ হচ্ছে দেখতে পাবেন। গভীর পাহাড়ের ভেতরে আপনি বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা ফুলের বাগানও দেখতে পাবেন। আশেপাশে অনেকগুলো ঝর্ণা আছে তবে চন্দ্রনাথ পাহাড়ে যাবার পথে শুধু একটি মাত্র ঝর্ণা দেখতে পাবেন।

পাহাড়ে ওঠার পথে যেখানে ঝর্ণা, সেখান থেকেই পাহাড়ে উঠার পথ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। ডানদিকের দিকের রাস্তা প্রায় পুরোটাই সিঁ‌ড়ি আর বামদিকের রাস্তাটি পুরোটাই পাহাড়ী পথ কিছু ভাঙ্গা সিঁ‌ড়ি আছে। বাম দিকের পথ দিয়ে উঠা সহজ আর ডানদিকের সিঁ‌ড়ির পথদিয়ে নামা সহজ এমনটাই স্থানীয়রা বললো। তবে আমরা পরীক্ষা করার জন্য শাওন গেলো বামের পাহাড়ী সাধারণ পথে, আর আমি ও আনিস সিড়ি ওয়ালা পথে।

যাই হোক আমার হালকা পাতলা শরীর এবং আমাদের দুইজনের ছোট্ট দল, এগুলো বিবেচনায় রেখে আমরা সিড়ি ওয়ালা এই পথটি নির্বাচন করি পাহাড়ে উঠার। যদিও অধিকাংশ ট্রাভেলারের মতে এই পথে নামা সহজ, উঠা সহজ মাটির রাস্তা দিয়ে। কিন্তু কি আর করা, হাজার হলেও শখে এসেছি সেটা মেটাতে তো হবে। অবশ্য ১৯৯৭ সালে চ্যাংড়া বয়সে একবার উঠেছিলাম এই পাহাড়ে।

তবে কিছু সিড়ি উঠার পর বুঝতে পারলাম মনের বয়স না বাড়লেও শরীরের বয়সটা যথেষ্টই বেড়েছে। আপনি খাড়া উপরের দিকে উঠা মানেই আপনি মধ্যাকর্ষণের বিপরীতে চলছেন, তাই যাত্রাটা হয় প্রচুর কষ্টকর। বৌ যদিও সাথে আসেনি কিন্তু আমাকে কাপড়-চোপড়, পাওয়ার ব্যাংক, চার্জার, ওয়াটার বোটল, মধু এসব দিয়ে এক ট্রাভেল ব্যাগ ধরিয়ে দিয়েছে যার ওজন কম করে হলেও দশ কেজি হবে। সেই ব্যাগ কাধে নিয়ে আমিতো বিশ-ত্রিশ ধাপ উঠে উঠে হাপানী রোগীর মতো হা করে শ্বাস নিচ্ছি। ওদিক থেকে শাওন মাঝে মাঝেই “ও ভাই” বলে ডাক দিয়ে জানান দিচ্ছিলো কতটুকু দূরত্বে আছে। সাথে সাথে আমরাও রিপ্লাই দিচ্ছিলাম।

অবশেষে শেষ দুই বাঁক উঠার আগে এনার্জি Nil হয়ে গেলো। হৃদপিণ্ডের অস্বাভাবিক palpitition থামাতে মিনিট দশেকের বিরতি নিলাম এক টং দোকানে। দু’আ পড়ে পানি খেলাম। একটু পর এনার্জি ফিরে এলে আবার চলতে শুরু করলাম। শেষ ধাপের আগে একটা বটগাছ আছে সেখানে আবার একটু বিরতি দিয়ে দু’রাকাত নফল সলাত আদায় করলাম। অনেকেই অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিলো হুজুর এই মন্দির এলাকায় করছে টা কি! যাক আমি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে সলাত শেষ করে দ্রুত পাহাড়ের চূড়ায় উঠে গেলাম।

শাওন আগেই উঠে গিয়েছিলো পাশের পাহাড় বেয়ে। আমরা তিনজনে ক্লান্তি এড়ানোর জন্য কচি ডাব খেলাম। এরপর টুকটুক ফটো সেশান চললো স্মৃতি রাখার জন্য।

পাহাড়ের চূড়ায় নির্মল আবহাওয়ায় আধা ঘন্টা কাটিয়ে আমরা আবার নীচে নামতে শুরু করলাম। যারা বলেছিলো নামাটা সহজ তাদের কে খুঁজতেছিলাম ওদের কাঁধে সিন্দবাদের দৈত্যের মতো সওয়ার হয়ে নামতে। নামার সময় দেখি বছর পঞ্চাশোর্ধ এক মহিলা ছেলে, ছেলের বৌ, দুই নাতনি সহ উঠছে, মন্দিরে পুজো দেওয়ার জন্য। ভাবলাম, মুসলিম হয়ে সামান্য পাঁচশ মিটার সমতল দূরত্বে মসজিদে যেতে চাই না। অথচ এই বৃদ্ধ মহিলা, শিশু বাচ্চা কি এক অদৃশ্য টানে তর তর করে পাঁচশ মিটার পাহাড় বেয়ে উঠছে।

কাগজ কলমে চন্দ্রনাথ পাহাড় ১১৫২ ফুট উচু বলা হলেও আমার কাছে ১৬-১৭শ ফুট মনে হয়েছে। প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লেগেছে আনুমানিক ২,২০০ (+/-) সিঁড়ি বেয়ে মূল শৃঙ্গে পৌঁছতে।

অবশেষে পাহাড়ের চূড়া থেকে সমতলে নেমে আসতে আসতে দুপুর হয়ে গেলো। পাহাড়ী কচি শশা খেয়ে আবার সিএনজি অটোরিক্সায় ছুটে চললাম পরবর্তী গন্তব্য “বাঁশবাড়িয়া সী বিচ” এ…

 

About Akik Russel-আকিক রাসেল

একজন মানুষ। একজন অনুগত মুসলিম। আল্লাহর দুনিয়ার প্রাকৃতিক নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখতে ঘুরে বেড়াতে ভালবাসি।

Posted on ডিসেম্বর 19, 2017, in ভ্রমণ and tagged , , , . Bookmark the permalink. এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান.

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান