Monthly Archives: ফেব্রুয়ারি 2018

ঘুরে এলাম ফুলের গ্রাম “সাবদী”

অফিসের একঘেয়েমি কাজ করতে করতে হাত-পাগুলো পর্যন্ত অনুযোগ করা শুরু করেছিলো। ঘুর ঘুর করা মনটাও হাপিয়ে উঠেছিল। কি আর করা মোবাইল খোলা রাখলে ছুটি কাটানোটা আমার জন্য দায় হয়ে যায়! তাই ফজরের পর মোবাইল বন্ধ করে দিলাম এক ঘুম। এক ঘুমে এগারোটা। বৌ আর বাচ্চাকে আগেই বলে রেখেছিলাম যেন ডাকাডাকি না করে। আমি দোআহারী হওয়ায় এমনিতেই সকালে কেও ডাকে না অফিস টাইম ছাড়া।

যাক উঠে ফ্রেশ হয়ে বারোটায় ছোট ভাই-বন্ধু শাওনকে ফোন দিলাম। উদ্দেশ্য হঠাৎ মাথায় উদয় হওয়া নারায়ণগঞ্জের সাবদি ঘুরতে যাবো। ও প্রথমে অনেক অজুহাত দেখালেও পরে রাজি হলো। আমি যুহরের সলাত আদায় করে বেলা আড়াইটার দিকে বের হলাম। বৌদ্ধমন্দির স্টপেজ থেকে লাব্বাইক বাসে উঠে পড়লাম সাইনবোর্ড নামবো বলে। বাসে উঠেই ট্রাভেলার্স এক্সপ্রেস গ্রুপের Saiful Gazi আর Rafiqul Islam ভাইকে নক দিলাম। সাইফ ভাই বললো আজকে সকালেই নাকি নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা এসেছে তাই সরি…😢। এরপর কয়েকবার চেষ্টায় রফিক ভাইকে পেলেও কথা দিলেন ফিরতি পথে চাষারা এসে সঙ্গ দিবেন। আমি সাইনবোর্ড নেমে লোকাল সিএনজি নিয়ে চাষারা পৌছাতে প্রায় সোয়া চারটা বেজে গেল। গিয়ে রফিক হলের সামনে শাওনকে পেলাম। এরপর রিক্সায় দুজনে চললাম বন্দরের উদ্দেশ্যে। মিনিট দশেকের মধ্যেই বন্দর চলে এলাম। এরপর নেমে জনপ্রতি দুই টাকা টোল দিয়ে ট্রলারে শীতলক্ষ্যা নদী পার হলাম।

ওপারে নেমে ব্যাটারী চালিত রিক্সায় রওনা দিলাম কাঙ্খিত ফুলের গ্রামের দিকে। মিনিট বিশেকের মধ্যেই সাবদী গ্রামের নদীর পাড়ে পৌঁছে গেলাম। শিল্পাঞ্চল নারায়নগঞ্জের বুক চিরে বয়ে যাওয়া শীতলক্ষ্যার পূর্ব পারেই এই ফুলের গ্রাম। আমরা যেখানে নামলাম সেখানকার সাইনবোর্ডে লেখা দেখলাম “হাজরাদী চাঁনপুর নদীর পাড়, সাবদী বাজার”। আসরের ওয়াক্ত হয়ে যাওয়ায় স্থানীয় মাসজিদে রব্বে কারীমের হক্বটা আদায় করে নিলাম। এরপর সোজা নদীর ঘাটে দাড়িয়ে বুক ভরে বিশুদ্ধ বাতাস টেনে নিলাম কিছুক্ষণ। শরীরটা প্রাকৃতিক ফুয়েল পেয়ে চাঙ্গা হয়ে উঠলো। ওলি হয়ে আমরা হেঁটে চললাম ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে।

ঢাকার খুব কাছেই এমন সুন্দর একটা গ্রামের পীচ ঢালা পথ ধরে হেঁটে চলতে ভালোই লাগছিলো। বাংলাদেশের সব গ্রামই সুন্দর, কিন্তু কিছু গ্রাম এর থাকে আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য ধারণ করে আছে। ধরুন সুন্দর একটি রাস্তা ধরে হেঁটে বা গাড়িতে চলছেন আর রাস্তার পাশ ঘেষে আছে হলুদ, লাল, সাদাসহ বিভিন্ন রঙের বাহারি ফুল গাছের সারি। তবে আপনার পথচলাটা কতটা আনন্দময় হবে একবার ভাবুন তো। হ্যা, এমনি একটি গ্রাম সাবদী। যা কি না ফুলের গ্রাম সাবদী বলে এলাকার মানুষজন জানে। চারিদিকে শুধু ফুল আর ফুল। সারি সারি লাল, হলুদ, কমলা, সাদা রঙের গ্যালাডিয়া, নানা রঙের গাদা, চেরী, জিপসি, ডালিয়া, গোলাপ, জবা আর কাঠবেলীর বাগান দেখে যে কারোই মন ভালো হয়ে যায়। ওখানে গেলে যে শুধু গ্রাম আর ফুলের বাগান দেখা হবে তা কিন্তু নয়, এর সবচেয়ে অসাধারণ হলো প্রেমতলা, লক্ষ্মণবন্দে নদীর পার, অনায়াসেই একটা বিকাল আপনি নির্দোষ আড্ডা দিয়ে কাটিয়ে আসতে পারবেন। মন চাইলে আর প্রস্তুতি থাকলে নদীতে নেমে কিছুক্ষণ ঝাপাঝাপি করে নিজেকে শীতল করে নিতে পারবেন। মন চাইলে কিছুটা সময় নৌকা ভাড়া করে ঘুরতেও পারবেন।

মূল রাস্তা ছেড়ে ডানেই দিগন্ত জোড়া ফুল আর ফুল। কাঠমালতি, গাঁদা, বেলী, চেরী, জিপসি, গ্যালাডিয়া, ডালিয়া, গোলাপ, জবা আর কাঠবেলীর ফুলে ছেয়ে আছে জমিনগুলো। দূর থেকে মনে হয় যেন দিগন্ত জুড়ে রঙ বেরঙের কার্পেট দিয়ে মুড়িয়ে দেয়া হয়েছে মাঠের পর মাঠ। আমি আর শাওন ঘন্টা খানেক গ্রামের মেঠো পথে হেঁটে হেঁটে ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। ফুলচাষীদের সাথে গল্পও করলাম কিছুক্ষণ। সৌন্দর্য্য উপভোগের পাশাপাশি মোবাইলের ক্যামেরায় স্মৃতি ধরে রাখতে ভুল করিনি।

মাগরিবের সময় ঘনিয়ে আসছিলো। আমরা আর দেরী না করে রিক্সা নিয়ে ফিরে চললাম বন্দরের দিকে। বন্দরে পৌঁছেই ট্রলার পেয়ে গেলাম। ওপারে পৌঁছে যথারীতি ২টাকা টোল পরিশোধ করে যেইনা রিক্সায় উঠেছি অমনি রফিক ভাই ফোন দিলেন, উনি বন্দরে ওয়েট করতেছেন আমাদের জন্য। আমরা রিক্সা ছেড়ে দিলাম। মনির হোটেলের সামনে Meet হলো। এরপর তিনজনে নতুন রিক্সায় চাষাড়া শহীদ মিনারে এসে নামলাম। নেমে প্রথমেই চাষাড়া মোড়ের মসজিদে মাগরিবের সলাত আদায় করে নিলাম। এরপর শহীদ মিনারের পাশে শাওনের পরিচিত মোবাইল হোটেল থেকে লুচির সাথে কলিজা ভূনা শেষ করে স্যূপ খেলাম। মানটা মোটামুটি ভালোই। যদিও গরম চা খেলে আমার জিহ্বায় ফোস্কা পুড়ে যায় তবুও টাটকা তেতুল, মরিচ আর পুদিনা পাতার চা দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না।

আড্ডার ফাকে ফাকে শাওনের মোবাইলে ওর বৌয়ের ফোন আসছিলো। বাসায় ওর মামা বেড়াতে এসেছে। তাই চা টা শেষ করে পঞ্চবটি এলাকার বাসিন্দা রফিক ভাইয়ের আন্তরিক উপভোগ শেষে বিদায় নিয়ে দ্রুত রওনা দিলাম ঢাকার দিকে। পথিমধ্যে শাওন নেমে গেলো স্টেডিয়াম এলাকায় আর আমি চললাম একটা সুন্দর বিকেল আর সন্ধা উপভোগের স্মৃতি নিয়ে আপনালয়ে…

নারায়ণগঞ্জ বন্দর উপজেলায় সাবদী গ্রামের পাশাপাশি এলাকা দিঘলদী, কল্যাণদী, মাধবপাশা, সেলসারদী গ্রামেও রয়েছে বিঘার পর বিঘা ফুলের বাগান। আপনার বোরিং লাগলে খুবই কম সময়ের মধ্যে কোথাও ঘুরে আসতে পারেন, কাটিয়ে আসতে পারেন উপভোগ্য কিছু মুহূর্ত। এমনি একটি জায়গা হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের সাবদী গ্রাম।

যেভাবে যাবেন :
গুলিস্থান জিপিও থেকে নারায়ণগঞ্জ গামী নন এসি উৎসব বা বন্ধন এ বা এসি বিআরটিসি তে নারায়ণগঞ্জ গিয়ে চাষারা নেমে রিক্সায় একদম বন্দর। এরপর ২ টাকায় ইঞ্জিন নৌকায় (ট্রলার) বা ৫ টাকায় বৈঠা নৌকায় পার হতে পারেন আপনি। তারপর অটো বা রিক্সায় সাবদী।