নারায়ণগঞ্জ কদম রসূল দরগাহ্

শীতের প্রথম সংক্ষিপ্ত সফরনামা :
নারায়ণগঞ্জ কদম রসূল দরগাহ্

আগেই বলেছিলাম বেশ কিছুদিন যাবত বাসা টু অফিস, অফিস টু বাসা করতে করতে হাপিয়ে উঠেছিলাম।

দিনটি ছিলো বাংলাদেশ সরকারের ঘোষণায় ১২ই রবিউল আওয়াল।

নারায়ণগঞ্জ শহর ঘুরে আমি আর শাওন চললাম নবীগঞ্জ ঘাটের দিকে। রিক্সায় ঘাটে পৌঁছতে মিনিট পনের লাগলো। ঘাটে পোঁছে ইঞ্জিন চালিত নৌকায় না উঠে দাড় টানা নৌকা রিজার্ভ করলাম মাত্র তিরিশ টাকায়! ইচ্ছে ছিলো শীতলক্ষ্যার সৌন্দর্য দেখবো নির্মল হাওয়ায়। কিন্তু নদীর পানি এতটাই প্রচন্ড গন্ধ ছিলো যে, নিমিষেই শখ উধাও হয়ে গেলো। নতুন বরের মতো নাকে রুমাল চেপেও গন্ধ আটকাতে পারছিলাম না। মিনিট দশেকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম নবীগঞ্জ ঘাটে।

নারায়ণগঞ্জ শহর থেকে তিন মাইল উত্তরে শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্বপাড়ে নবীগঞ্জ। এই নবীগঞ্জেই অবস্থিত কদম রসূল দরগাহ্। কদম রসূল বলতে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)- এর পায়ের ছাপ কে বোঝানো হয়েছে। কথিত ভাষ্য অনুযায়ী এখানে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর কদম মোবারকের ছাপ সম্বলিত একটি পাথর রয়েছে।

বিভিন্ন সূত্রের ইতিহাস ঘেটে জানা যায়, ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দের দিকে ঈসা খাঁর সেনাপতি মাসুম খাঁ কাবুলি একজন আরব বণিকের কাছ থেকে বিশালাকার পায়ের ছাপ বিশিষ্ট এ কালো পাথরটি কিনেছিলেন। পরে তিনি এই দরগাহ্ নির্মাণ করে তাতে পাথরটি স্থাপন করেন । তারপর সুলতান শুজা এই দরগাহ্’র জন্য ৮০ বিঘা জমি দান করেন। সে সময় এই দরগাহ্’র ইমারতটি কেমন ছিল তা জানা যায় না। এর পরে ঈসা খাঁর প্রপৌত্র দেওয়ান মনোয়ার খান এখানে একটি ইমারত তৈরি করেন। কিন্তু সেই ইমারতও কালের গর্ভে বিলিন হয়ে যায়। এর অনেক পরে তৎকালীন ঢাকায় বসবাসকারী কুমিল্লা জেলার টোরা পরগনার জমিদার গোলাম নবী ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে নতুন করে একটি দরগাহ নির্মাণ করেন এবং তাতে পবিত্র পাথরটি স্থাপন করেন। তখন ১ গম্বুজ বিশিষ্ট একটি ইমারত ছিল। এর পরে গোলাম নবীর তৃতীয় পুত্র গোলাম মোহাম্মাদ ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমদিকের দোতলা তোরণটি নির্মাণ করেন।

কদম রসূল দরগাহ্’র সামনে কারুকার্জ করা একটি সুউচ্চ তোরণ রয়েছে। দেখে মনে হবে যেন কোনো মসজিদ বা মাজার। আসলে এটা দরগাহ্’য় প্রবেশের মূল ফটক। ২৫টি সিঁড়ি ডিঙিয়ে প্রবেশ করতে হয় দরগাহ শরিফে।
তোরণ পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই বাম দিকে রয়েছে একটি মাসজিদ। ডান দিকে রয়েছে ১৭টি পাকা কবর। দরগাহ শরিফের খাদেম জানান, কদম রসুল দরগার প্রতিষ্ঠাতা মাসুম খাঁ কাবুলির বংশধরদের কবর এগুলো।
ঠিক মাঝ বরাবর এক গম্বুজ বিশিষ্ট ছোট্ট একটি কক্ষ রয়েছে। যেখানে রাসূলুল্লাহ মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কদম মুবারকের ছাপ সংবলিত কথিত পাথরটি সংরক্ষিত রয়েছে।

দরগাহ্ গেট দিয়ে প্রবেশ করে সরাসরি চলে গেলাম ঐ ছোট্ট কক্ষটিতে যেখানে রাসূলের কথিত কদম মুবারকের ছাপ ওয়ালা পাথরটি আছে। ঢুকতেই দেখি একজন মধ্যবয়সী খাদেম আতর ও গোলাপজল মাখানো পাথরটি হাতে দাড়িয়ে আছেন। লোকজন নজরানার বিনিময়ে পাথর ছুটে হাতে চুমু খাচ্ছেন এবং সেটা ধোয়া পানি নিয়ে যাচ্ছেন। দরগাহ কর্তৃপক্ষ জানান, দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ কদম মুবারকের ছাপ সম্বলিত কালো পাথরটি দর্শন পেতে এখানে ছুটে আসে। প্রত্যেকেই আসে কোনো না কোনো বাসনা নিয়ে। ভক্ত-আশেকানদের পাথরটি স্পর্শ করে মুখমণ্ডল মাসেহ করতে দেখা যায়। বাসনা পূরণের আশায় পাথর ধোয়া পানি কিংবা গোলাপ জল পান করে অনেকেই।

বারোই রবিউল আওয়াল হওয়ায় ক্ববর, মাজার, দরগাহ্’য় যেই ভীড় থাকে, এখানেও তার ব্যতিক্রম দেখতে পেলাম না। দক্ষিণমুখী বিশাল গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখা গেল মাজারের সুপ্রশস- প্রাঙ্গণজুড়ে শত শত নারী পুরুষের সহবস্থান। কেউ বসে, কেউ শুয়ে, কেউ দাঁড়িয়ে, কেউবা আবার আধশোয়া হয়ে মিলাদ পড়ছে। পাশেই বিশাল বিরানির ড্যাগ। মিলাদ শেষে ভক্ত আশেকানদের তবারুক হিসেব দেয়া হবে তা।

আচ্ছা গাজা সিগেরেটে অভ্যস্ত না হলে কি মাজারে অবস্থান করা যায় না নাকি? সালু কাপড়ে একেক বাবার একেক বেশ। কারো বাবরী আছে দাড়ি নেই, কারো দাড়ি আছে বাবরী নেই। তবে সবার যেটা আছে সেটা হল জট। চুল দাড়িতে জট। আবার এর মধ্যে মহিলাও আছে।

আশ্চর্য হলাম না মাজারের ঠিক পাশেই মাসজিদ খালি দেখে! সুবিশাল মাসজিদ। জিজ্ঞেস করে জানলাম দিনরাত সর্বদা হাজার হাজার লোকে মাজার লোকারণ্য থাকলেও নামাজের সময় মাসজিদ থাকে খালি। নামাজের সময় মাত্র চার থেকে পাঁচটা কাতার হয়।
এখানে আগতদের যত ইবাদত, মানত, চাওয়া পাওয়া সবই মাজার কেন্দ্রিক। মজার ব্যপার হলো, মাজারের খাদেমকে পর্যন্ত নামাজের সময় নির্বিকার বসে থাকতে দেখা গেল মাজারে। মসজিদে আল্লাহর দরবারে সিজদাহ্ দেয়ার লোক পাওয়া না গেলেও শতশত নারীপুরুষকে পাওয়া গেলো মৃত মানুষের ক্ববরে (তাদের ভাষায় মাজার) সিজদারত অঅবস্থায়! পাশেই সালু পড়া একদল গাজা টেনে যাচ্ছে আর একদল বাদ্য বাজিয়ে গান গাচ্ছে-

পানিত্ তলে মোম বাত্তি
বাও বাতাসে নিভে না।
বাবার নামে হালকা দিলে
অজু গোসল লাগে না!
মোল্লা মুনশি নমাজ পড়ে
মারেফত ত জানে না!
বাবার নামে হালকা দিলে
সতর ঢাকন লাগে না!

ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউ’ন!
আস্তাগফিরুল্লাহ! আল্লাহ্ এসব মানুষের ক্বলব সংশোধনের মাধ্যমে প্রকৃত দ্বীনের হিদায়াত দান করুন।

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কদম মুবারক (যদিও প্রমাণিত নয়)কে কেন্দ্র করে যে দরগাহ্ গড়ে উঠেছে তাতে এমন শিরকের আখড়ায় পরিণত করা হয়েছে দেখে নিদারুণ মর্মাহত হলাম। আল্লাহ্ সবচেয়ে সম্মানিত রাসূলের আদর্শ ছিল তাওহীদ আর এখানে তাঁর নামেই চলছে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী ভ্রান্ত কর্মকাণ্ড!

আর দেরী করাটা সমীচীন মনে হলো না তাই দ্রুত বেড়িয়ে আসলাম দরগাহ্ প্রাঙ্গণ থেকে।
এভাবেই ভারাক্রান্ত হৃদয়ে শেষ করতে হলো শীতের প্রথম সংক্ষিপ্ত সফরনামার কদম রসূল দরগাহ্ পর্ব।

About Akik Russel-আকিক রাসেল

একজন মানুষ। একজন অনুগত মুসলিম। আল্লাহর দুনিয়ার প্রাকৃতিক নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখতে ঘুরে বেড়াতে ভালবাসি।

Posted on ডিসেম্বর 15, 2017, in ভ্রমণ and tagged . Bookmark the permalink. এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান.

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান